হিউম্যান সাইকোলজি
এখানে আমরা বেশ কয়েকটি হিউম্যান বিহ্যাভিয়ার কিংবা মানুষের সাধারণ কয়েকটি প্রবৃত্তি নিয়ে আলোচনা করবো। যা সচরাচর আমরা করে থাকি। তা হতে পারে চেতনে কিংবা অবচেতনে।
আমাদের সবার মন্দ কিছু ক্ষমতা আছে।
শুনতে অবাক লাগলেও এটাই সত্যি। হ্যাঁ, আমাদের সবারই মন্দ কাজ করার এক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে এবং সুযোগ পেলেই আমরা মন্দ কাজ করতে বেশ পছন্দ করি। আপনি হয়তো আশেপাশের জীবন থেকে এই বিষয়ে বিস্তারিত ধারণা অনেক আগেই পেয়ে গিয়েছেন। জীবনের এই চলার পথে আমাদের এই অভিজ্ঞতাগুলো বেশ তিক্ত এবং অবিশ্বাস্য ও বটে! তাহলে আসুন জেনে নিই এই বিষয়ে একটি গবেষণার সারমর্ম।

মনোবিজ্ঞান এর ইতিহাসে সবচেয়ে বিখ্যাত পরীক্ষা ছিলো এটি। সাল ১৯৭১। সামাজিক অবস্থা কীভাবে মানুষের আচরণকে প্রভাবিত করতে পারে তার উপর একটি মনোবিজ্ঞান গবেষণা করতে দেয়া হয়েছিল স্ট্যানফোর্ড কারাগারকে। নেতৃত্বে ছিলেন মনস্তাত্ত্বিক ফিলিপ জিম্বার্ডো্ (Philip Zimbardo)। গবেষকরা এক হয়েছিলেন স্ট্যানফোর্ড সাই বিল্ডিং এর বেসমেন্টে। সেখানে একটি জাল জেল তৈরি ছিল। অর্থাৎ জেলের মতো দেখতে হলেও সেটি জেল ছিলো না। নকল সেই জেলে বন্দী এবং রক্ষীবাহিনী হিসাবে কাজ করার জন্য ২৪ জন স্নাতকোত্তর ভলান্টিয়ার কে বেছে নেয়া হয়েছিলো। তাদের পূর্বে কোন আপরাধ-ধর্মী কাজের রেকর্ড ছিল না এবং তারা মানসিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ ছিল।
গবেষকরা লুকানো ক্যামেরা ব্যবহার করে বন্দীদের ( যাদের ২৪ ঘন্টাই জেলে কাটাতে হয়) এবং গার্ড (যারা আট ঘণ্টা করে সময় ভাগাভাগি করে) পর্যবেক্ষণ করে। যে এক্সপেরিমেন্টটি দুই সপ্তাহ ধরে হবার কথা ছিলো, তা ৬ দিনের মাথায় স্থগিত করা হয়। আসলে করা হয় বললে ভুল হবে। কর্তৃপক্ষ স্থগিত করতে বাধ্য হয়। রক্ষীদের তীব্র কঠোর আচরণ এবং অনেক সময় তারা বন্দীদের উপর জঘণ্য মানসিক অত্যাচার চালাতো জিম্বার্ডো বলেন,
"রক্ষীরা বন্দীদের বিরুদ্ধে তাদের আগ্রাসন বর্ধিত করে, তাদের উলঙ্গ করে, তাদের মাথার উপর ব্যাগ রাখে এবং পরিশেষে তাদেরকে যৌন নিপীড়নের শিকারে পরিণত করে"। ছয় দিন পরে আমাকে এটা শেষ করতেই হতো কারণ এটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল - আমি রাতে ঘুমাতেও পারিনি এই দুশ্চিন্তায় যে রক্ষীরা না জানি বন্দীদের কি করে বসে।"
শুধুমাত্র বন্দী হবার অপরাধে কয়েকটি নিরপরাধ মানুষকে পেতে হয়েছিলো নির্মম সাজা। অন্যদিকে নিরপরাধ জেনেও রক্ষীরা মানসিক কিংবা দায়িত্বজনিত কারণে হোক তাদেরকে নিপীড়িত করেছে। এটাই আসলে মানুষের একটি অন্যতম সাধারণ প্রবৃত্তি। আমরা সুযোগে অন্যায় করতে দ্বিধাবোধ করি না। আর একেই বলে মানুষের সাধারণ মন্দ হবার কিংবা নষ্ট হবার অদ্ভুত ক্ষমতা।
ভালো কিছুর জন্য ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে পারে, তারাই পরবর্তীতে বেশি সফল হয়!
এটি অনেকটা "সবুরে মেওয়া ফলে" টাইপের। অর্থাৎ আপনি যত বেশি অপেক্ষা করবেন, অন্যদের তুলনায় ততবেশি সফল হবেন। ব্যাপারটি আবার লোভের দিক থেকেও ব্যাখ্যা করা যায়। আপনি যদি আপনার লোভ দমন করতে পারেন, তবে নিশ্চিত থাকেন ভবিষৎ আপনার জন্য বিশেষ পুরষ্কার নিয়ে অপেক্ষা করছে।
1960-এর দশকের শেষের দিকেকে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি পরীক্ষায় তাৎক্ষনিক সন্তুষ্টির প্রলোভন রোধ করার একটি মনোবিজ্ঞান পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষায় এমন শিশুদের নির্বাচন করা হয়েছিলো যারা এখনো স্কুলে ভর্তি হয়নি। সেই এক্সপেরিমেন্টটি শিশুদের প্রলোভন(লোভ) ক্ষমতা পরীক্ষা করে। এবং তাদের আত্ন-নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা ও স্ব-শৃঙ্খলা (Self Descipline) সম্পর্কেও ভালো ফলাফল পাওয়া যায়।
পরীক্ষায় চার বছর বয়সী ছেলেমেয়েদের সামনে একটি প্লেটের উপর অনেক মাশরুম দিয়ে রাখা হয়েছিল এবং বলা হয়েছিল যে, তারা এখন এই মাশরুমগুলো খেয়ে ফেলতে পারে অথবা গবেষকরা ১৫ মিনিট পরে ফিরে আসার আগ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারে। যদি অপেক্ষা করতে পারে তাহলে পুরষ্কারের ব্যবস্থাও ছিলো। কেননা গবেষকরা ফিরে এসে তাদের অতিরিক্ত আরো দুইটি মাশরুম দিবে।
টাইমের রিপোর্ট অনুযায়ী যদিও বেশিরভাগ শিশু বলেছিল যে তারা অপেক্ষা করবে। তারা প্রায় সবাই তাদের লোভকে দমন করার জন্য চেষ্টা করে। কিন্তু শেষপর্যন্ত না পেরে গবেষকদল ফিরে আসার পূর্বেই অনেকে মাশরুম খেয়ে ফেলে। যেসব শিশুরা ১৫ মিনিট তাদের লোভকে দমন করতে পেরেছিলো তারা কিছু কৌশল অবলম্বন করেছিল। যেমন, চোখ বন্ধ করে, কিংবা উল্টা ঘুরে বসে থেকে।
এক্সপেরিমেন্টের দীর্ঘমেয়াদী ফলাফল বেশ আশ্চর্যজনক ছিলো। পরবর্তীতে সেসব শিশু যারা অপেক্ষা করে ছিল তাদের মাঝে নিচের বৈশিষ্ট্যগুলো পাওয়া গিয়েছিলঃ
- তাদের আচরণগত সমস্যা, মাদকদ্রব্যে আকৃষ্ট হওয়ার প্রবণতা এবং স্থূলতা এসব অন্যদের তুলনায় অনেকাংশে কম ছিল।
- এবং তারা পরবর্তীতে জীবনে অন্যরা যারা শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারেনি তাদের তুলনায় সফল ছিল।
অর্থাৎ আপনি যদি অপেক্ষা করেন কিংবা সবুর করেন, তবে আপনার জীবনে মেওয়া ফলবেই! 🙂
আমরা ক্ষমতা পেলেই তার অপব্যবহার করি!
ক্ষমতা থাকলে সে ক্ষমতার অপব্যবহার করা আমাদের একটা মানসিক ব্যাধি। মোটামুটিভাবে আমরা জীবনের কোন না কোন পর্যায়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করতে পছন্দ করি কিংবা করতে ভালোবাসি। এটার পেছনে একটি সাইকোলজিক্যাল কিংবা মনস্তাত্বিক ব্যাখ্যা ও রয়েছে।২০০৩ সালের এক গবেষনায় প্রকাশিত এক জার্না্লের রিভিয়্যু লেখার জন্য তিনজন ছাত্রকে পাঠানো হয়েছিলো। কাগজপত্র লেখার জন্য দুই ছাত্রকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। অন্যজনকে কাগজটির মূল্যায়ন করতে এবং প্রতিটি ছাত্রকে কতটা অর্থ প্রদান করা হবে তা নির্ধারণ করতে বলা হয়েছিল।
তাদের কাজের মাঝখানে গবেষক একটি প্লেটে করে ৫ টি কুকি(এক ধরণের খাবার) রেখে গেল। সাধারণভাবেই শেষ কুকিটা কখনও খাওয়া হয় না (কারণ ওরা সব মিলে চারজন ছিলো)। তবুও তাদের মধ্যে যে লিডার, সে প্রায় সবসময় চতুর্থ কুকি খেয়ে থাকেন এবং শেষের কুকিটাও তার ভাগ্যেই থাকে। ব্যাপারটা অনেকটা মানসিকভাবেই সবাই মেনে নেয় যে যিনি লিড দিবেন তিনিই বেশি ভাগ পাবেন। আবার লিডারও তাদের মনের মধ্যে এই ধারণা পুষে রাখেন। সমাজের প্রায় প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে এই উদ্ভট ধারণা বিদ্যমান।

বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী Dacher Keltner বলেন,
" বিজ্ঞানের বিভিন্ন গবেষণায় অনেক গবেষক অনেক জনবলকে কাজে লাগান এবং বিভিন্ন ভাবে তাদের উপর প্রভাব খাটাতে পছন্দ করেন। তাদের চলাফেরা, পোষাক পরিচ্ছেদ, কথা বলার ভঙ্গি এমনকি খ্যাদাভাসেও। মাঝে মাঝে তাদেরকে যৌনহয়রানি পর্যন্ত করা যন
এই বিষয়টির জন্য আসলে গবেষণার খুব একটা প্রয়োজন হয়না, আমরা আমাদের আশেপাশে হরহামেশাই এসব ক্ষমতার অপব্যবহারের উদাহরণ দেখতে পাই। একজন প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে একজন পিয়ন পর্যন্ত এই নীচ কাজে জড়িত। এটা মানুষের এক ধরণের মানসিক ব্যাধি।
আমাদের সুখী হবার জন্য শুধু একটি জিনিসের প্রয়োজন।
জীবনে সুখী হবার জন্য আমরা কত কি না করি! টাকা কামাই, বাড়ি বানাই, গাড়ি কিনি। অনেকে আবার মোটিভেশনাল স্পীকারদের দরজায় নিয়মিত কড়া নাড়ি! কিন্তু আমরা কি কখনোই জানতে চেয়েছি কোথায় আমাদের প্রকৃত সুখ! সুখী হবার জন্য বেশি কিছু না, মাত্র একটি জিনিষের খুব প্রয়োজন। আর মনোবিজ্ঞান গবেষকরা ভালবাসা নামক অনুভূতিটিকেই সেই একটি জিনিস হিসেবে অ্যাখায়িত করেছেন। জীবনে কিছুই দরকার নেই। যদি আপনার জীবনে ভালবাসা থাকে, তবে জীবনে আপনাকে বারবার ওয়েলকাম!

৭৫ বছর ধরে হার্ভাডের গ্রান্ট গবেষণাটি পরিচালিত হয়ে আছে। এটি পৃথিবীর অন্যতম দীর্ঘতম মনোবিজ্ঞান গবেষণা। ১৯৩৮-১৯৩৯ সালের হার্ভাডের পুরুষ গ্রাজুয়েটদের নিয়ে এটি শুরু হয়েছিলো (নব্বইয়ের দশকে এটি আরো জোরদার হয়েছিল)। এই গবেষণাটি গ্র্যাজুয়েটদের জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়মিত সংগ্রহ করে।
নিশ্চয় জানতে ইচ্ছে করছে গবেষণার ফলাফল কি! এতদিনের মনোবিজ্ঞানের উপর করা বিভিন্ন গবেষণার ফলাফল বলে যে, আপনি যখন দীর্ঘমেয়াদী সুখ এবং জীবনে কি পেলেন আর কি হারালেন তার হিসেব কষবেন, তখন ভালবাসাই সব বিষয়ের প্রকৃত সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।
গবেষণার দীর্ঘমেয়াদী পরিচালক মনোবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ জর্জ ভ্যালেন্ট বলেন, সুখের দুটি স্তম্ভ আছে: একটি হলো ভালোবাসা এবং অন্যটি জীবনের সাথে লড়াই করার উপায় খুঁজে বের করা। আর এই লড়াই করার উপায় এমন ভাবে খুঁজে নিতে হবে যেন সেটা ভালোবাসাকে জীবন থেকে দূরে সরিয়ে না দিতে পারে।
যারা একা থাকে তারা নিজেদের সুখী ভাবতে পারেন না, আবার একটা বয়সের পর একা থাকা মানুষগুলো শারীরিক, মানসিক অসুস্থতা যে অনেকের সাথে থাকে তার চেয়ে বেশি হয়।
No comments